জাপানিজ মনষ্টার: সুদূর উত্তর সংস্করণ পর্ব-১


জাপানে সুদূর উত্তরের দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ হকায়ডো, এটি ইযো নামেও পরিচিত, যার মানে "দ্য ল্যান্ড অফ দ্য বারবিয়ান (বর্বরদের দেশ)", এছাড়াও 'ইযো', 'ইসো', 'ইছো' নামগুলোতেও পরিচিত। এটি জাপানের দ্বিতীয় বড় দ্বীপ। এখানে আছে আদিম বন, মহিমান্বিত পাহাড়, আগ্নেয়গিরিয় মালভূমি। হকায়ডো পরিচিত হয়েছে এর অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য। এটি পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় জায়গা হিসেবে পরিচিত হয়েছে। ঠান্ডায় আচ্ছাদিত এই উত্তরের দ্বীপে বাস করে অদ্ভুত সব জীব, যারা মানুষের জ্ঞানের বাইরে লুকিয়ে আছে। এরা সেইসব দানব যাদের ডাকা হয় "ফার নর্দান ল্যান্ড হোম" নামে।
Published from Blogger Prime Android App
Image Source: Bing Copilot



যদিও বর্তমানে জাপানে কোন পরিচিত নেকড়ে নেই, তবে হকায়ডো একদা এর নিজস্ব নেকড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল । এদের হকায়ডো উলফ( ক্যানিচ লুপাচ হাট্টায় বা ক্যানিচ লুপাচ রেক্স), অথবা ইযো উলফ নামে পরিচিত ছিল। এছাড়াও আছে হনযু উলফ। এই দুই প্রজাতিকে একসময় জাপানে পাওয়া যেত। ইযো উলফ তার দক্ষিনের কাজিন হনসু উলফের চেয়ে বেশি ঐতিহ্য বহন করে। এটি অনেকটা কুকুর সদৃশ্য। এদের হাড় বৃহৎ এবং শক্তিশালী, শ্বাদন্তগুলো লম্বা ও বক্র, এবং তাদের শরীরের গঠন অন্যান্য ধূসর নেকড়ের মতোই। ইযো উলফ সাধারণ ধূসর বর্নের এবং হনসু উলফের থেকে বৃহৎ।



Image Source: Bing Copilot



হকায়ডো উলফরা এক সময় জাপানের উত্তরের আদিবাসী আইনোদের কাছে পূজনীয় ছিল। তাদেরকে মনে করা হতো শক্তিশালী দেবতা হিসেবে। আইনোদের মিথ, পুরাণ এবং কবিতায় তাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁরা আইনোদের কাছে বহু নামে পরিচিত যেমন হরকিউ কামুই (হাহাকারের দেবতা), উকুইকি কামুই(হরিণ শিকারি দেবতা), হরকো রেতারা কামুই (সাদা নেকড়ে দেবতা) এবং হরকো কামুই দোনো (লর্ড উলফ দেবতা)।

ইযো উলফদের পরাক্রমশালী শিকারি হিসেবে মনে করা হয়, এই কারণে অনেক আইনোদের গৃহে এরা লালিত হতো‌। এই বিষয়ে হকায়ডো ডেভোলফমেন্ট এজেন্সি অনেক তথ্য দিতে পারে। এই এজেন্সির তথ্য মতে অনেক আইনো ইযোদের শাবক পুষত, নেকড়েগুলো বড় হতে ২ বছর সময় নিত এবং গ্ৰামবাসিদের সাথে মানিয়ে নিতো, এরপর তাঁরা শিকারিতে পরিণত হতো এবং হরিণ শিকার করতে আইনোদের সাহায্য করতো।
.
১৮৬৮ সালে ফিউডাল সরকারের পতন হলে, জাপান আধুনিকরন জন্য পশ্চিমার সাহায্য চাই। সরকার বুঝতে পারে পশুপালন হচ্ছে হকায়ডো কৃষির সবচেয়ে বড় আশা। ঘোড়াসহ বিভিন্ন গবাদিপশু পালন শুরু হয়ে যাই হকায়ডো জুড়ে, এতে নেকড়ে পালন আরো বেড়ে যায়। তবে খুব বেশী দিন লাগে না নেকড়েকে শত্রু হিসেবে ধরে নিতে।

তাদের আক্রমণাত্মক আচরণ মানুষদের ক্ষতি করতে শুরু করে, ফলে এদের নিয়ন্ত্রন করতে স্টিকনিন পয়জনিং ক্যাম্পেইন শুরু হয়, এবং হকায়ডো ডেভোলফমেন্ট এজেন্সি বাউন্টি হান্ট সিস্টেম চালু করে এদের এক্সটার্মিনেশন করতে। এভাবে বলি হবার ফলে হকায়ডো উলফের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে কমতে থাকে। এবং শেষ পর্যন্ত ১৮৮৯ সালে তারা বিলুপ্ত ঘোষিত হয়।

এরপর থেকে আইনোরা দাবি করতে থাকে যে তারা এই নেকড়েদের দেখতে পায়, এবং বর্তমান সময়ও তাদের দর্শনের রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে। তবে মাঝে মাঝে, রাঞ্চ মালিকদের কাছ থেকে কিছু রিপোর্ট পাওয়া যায়, তারা দাবি করে যে তাদের গৃহপালিত পশু কোন এক অজ্ঞাত বন্য প্রাণী দ্ধারা খুন হচ্ছে। হাইকার এবং শিকারিরা নেকড়ের আর্তনাদ, এবং মাঝে মাঝে তাদের বিষ্ঠা ও পায়ের ছাপ বন্য পরিবেশে দেখতে পেয়েছেন।

তাহলে কি হকায়ডো নেকড়ে এখনো আছে? কে জানে? তবে এর থেকেও রহস্যময় এক বামনের মত জাতি আইনোতে বাস করত মানুষ বসতির আগে। আইনোরা এদের চেনে 'কোরোপোককুরু', অন্যভাবেও লেখা যায়, যেমন 'কোর-পোক-উন-কুর', 'কোরো-পোক-গুরু', 'কোরো পোকোনগুরু' । তাঁরা মাঝে মাঝে 'সুচিগুমো' নামেও ডাকা হয়। কোরোপোককুরু অর্থ হলো "বারডোক পাতার নিচে বাস করা লোকজন"। কিছু কিছু কাহিনীতে শোনা যায় তাদের পুরো পরিবার একটা পাতার নিচে বাস করতে পারে, যেখানে একটি পাতা ৪ ফুট লম্বা হয়। তাদের উচ্চতা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য পেলেও ২-৩ ফিট পর্যন্ত তাঁরা লম্বা হয়।

Image Source: Bing Copilot



তাদের ছোট উচ্চতার জন্য, কথিত আছে কোরোপোককুরুরা দেখতে কুসিৎ ও বন্য, বড় মাথা, এবং ছোট্ট নাকের অধিকারী হয়ে থাকে। আরো শোনা যায় তাঁদের মুখমণ্ডল লালচে বর্ণের। বেশিরভাগ বর্ননা মতে তাঁরা ছোট আকৃতির, গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, লোমশ ও অপ্রীতিকর হয়ে থাকে।

এই পাশবিক চেহারা সত্ত্বেও, কোরোপোককুরুরা বেশ কিছু গুনের অধিকারী বলে শোনা যায়। তাঁরা চকমকি পাথরের ব্যবহার জানত, পাথরের ছুরি, স্ক্যাপার ও সাধারণ কিছু জিনিস বানাতে পারতো, এছাড়াও মৃৎশিল্পের উপর তাদের দক্ষতা সম্পর্কে জানতে পারা যায়, যেগুলো আইনোরা বানাতে জানত না। এছাড়াও কোরোপোককুরুরা মাটি দিয়ে বাড়ি বানাতো, সাধারণ তাদের কুঁড়েগুলো গোলমুখি দরজা থাকত।

কোরোপোককুরুরা ভদ্রতার সাথে কথা বলতে পারত। তাঁরা আইনোদের সাথে সৌজন্যমূলক কথা বলত। আইনোদের মতে এই বামনরা খুব লাজুক ছিল, এবং সচরাচর দেখা দিত না। তবুও, মাঝে মাঝে তাঁরা আইনোদের সাথে বেচাকেনা করত, এবং সেটা করত রাতের বেলা। আর বেশিরভাগ সময় তাঁরা আইনোদের থেকে লুকিয়ে থাকত।

কোরোপোককুরু ও আইনোরা শান্তিতে বাস করছিল, কিন্তু হঠাৎ এক যুদ্ধ বাঁধল তাদের মাঝে। ধারণা করা হয় সেই যুদ্ধে কোরোপোককুরুরা সবাই মারা গেছে অথবা তাঁরা পালিয়ে গেছে। এরপর থেকে এই বামনরা একেবারেই হারিয়ে যায়।

বর্তমানে বেশ কিছু বছর ধরে প্রস্তাব করা হচ্ছে যে, হকায়ডোতে বেশ‌ জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায় এখানে আইনোরা ছাড়াও আরও কেউ বাস করতো। প্রত্মতান্ত্রিকগন অদ্ভুত মাটির তৈরি বাড়িঘর পেয়েছেন, যেগুলো কোরোপোককুরু সাথে মিলে যায়। বাড়িগুলোতে পাথরের কিছু সরঞ্জাম পাওয়া যায়, যেগুলো আইনোদের সাথে মিলে না, এছাড়াও রহস্যময় কিছু টুলস পাওয়া যায় যেগুলো ছোট, এবং সাধারণ মানুষের জন্য তা ব্যবহারের অনুপযোগী।

আরেকটি প্রত্মতান্ত্রিক আবিষ্কার করেন এডওয়ার্ড এস.‌ মোর্স, তিনি ১৮৭৭ সালে এমন একটি জিনিস আবিষ্কার করেন যার ফলে কোরোপোককুরুদের অস্তিত্ব জোরালো করে। ওমোরি নামের এক জায়গায় মোর্স একটি নৃতাত্ত্বিক মাটির পাত্রের ভাঙ্গা অংশ‌ খুঁজে পান, যেটি আইনোদের সংস্কৃতির সাথে মিলে না। মোর্স তার আবিষ্কারের কথা জানান ১৮৭৯ সালে, তিনি বলেন ওমোরিতে কোন আইনো বাস করত না, তবে কিছু নিওলিথিক প্রানি এখানে আইনোদের আগে বাস করত।

মোর্স আবিষ্কার প্রকাশিত হয় Shell Mounds of Ōmori নামে, যেটি সেই সময় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, এবং জাপানের নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্মতান্ত্রিক জন্ম হিসেবে পরিচিত পায়। শুবোই শোগোরো, মোর্সের এক ছাত্র সেই সাথে টোকিও ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর (তিনি Anthropological Society এর ফাউন্ডিং মেম্বার ছিলেন), তিনি এই মৃৎপাত্রগুলো দেখেন এবং কল্পিত প্রাচীন মানুষ ও বামন-সদৃশ্য কোরোপোককুরু মাঝে কোন সম্পর্ক আছে কিনা তা খুঁজে দেখেন।

শুবোই আইনোদের বলা ঘটনা পরীক্ষা করে দেখেন। তিনি বলেন এই মাটির পাত্রগুলো আইনোদের না। এবং তিনি মোর্সের ধারণাকেই সমর্থন করেন ‌। অন্যান্য নৃতাত্ত্বিকগন এই ধারণার সাথে এক মত হয়েছেন। তবে এর দ্বিমত পোষণ করেছেন অনেকে। তাদের প্রশ্ন যদি প্রস্তর যুগের কোন জীব, তাদের আকার মানুষের অর্ধেক, যারা মাটির ঘরে বাস করত, কোথায় তাঁরা আর কোথা থেকেই এলো? এখনও রহস্য।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন